একাডেমিক জ্ঞানচর্চার বিষয় হিসাবে পৃথিবীর এই অঞ্চলে সমাজবিজ্ঞানের শুভ
যাত্রা ১৯৪০ দশকের আগে থেকেই। সে সময় উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক
অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অংশ হিসেবে সমাজবিজ্ঞান পাঠদান করা হতো।
পরবর্তীতে ১৯৪০ দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের
অনার্সের পাঠ্যসূচীতে বিষয় হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয় সমাজবিজ্ঞান। এই সময়
রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স পাঠরত প্রত্যেক ছাত্রকে দ্যুই বিষয়ে সাবসিডিয়ারী
পত্রের জন্য ছয়টি কোর্স,
ইংরেজি সাহিত্যের ১টি কোর্সসহ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ৮টি কোর্স অর্থাৎ মোট
১৫টি কোর্সের উপর শিক্ষা দান করা হতো। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এই ৮টি পেপারের
অন্যতম কোর্স ছিল প্রারম্ভিক সমাজবিজ্ঞান। ১৯৫০ দশকের প্রথমার্ধে
বাংলাদেশের পথিকৃত সমাজ বিজ্ঞানী অধ্যাপক এ কে নাজমুল করীমের ঐকান্তিক
প্রচেষ্টায়,
বিশ্বখ্যাত ফরাসী নৃবিজ্ঞানী
Levis Straus
ইউনেস্কো বিশেষজ্ঞ হিসেবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন। প্রফেসর
ষ্টস দেশের মানব সম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্যে,
এই অঞ্চলের অপার সম্ভবনাময় প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের জন্য সুষ্ঠু উন্নয়ন
পরিকল্পনা গ্রহণের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন।তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম সফরে
যান এবং এই অঞ্চলকে সমাজ নৃতাত্বিকদের জন্য জীবন্ত স্বর্গ হিসেবে
আখ্যায়িত করেন। প্যারিস প্রত্যাবর্তনের পর প্রফেসর ষ্ট্রস বাংলাদেশের
উপজাতীয় জীবনধারা সম্পর্কে গবেষণার উদ্দেশ্যে তার সহকর্মী কয়েকজন গবেষককে
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পাঠান। একই সাথে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে
জ্ঞান চর্চার বিষয় হিসেবে সমাজবিজ্ঞান বিভাগ খোলার জন্য জোর সুপারিশ
করেন। এটাই ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি স্বতন্ত্র বিভাগ হিসেবে
সমাজবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠার প্রথম পদক্ষেপ।
পরবর্তীতে
Prof. Den Hollander
তাঁর
UNESCO
বিশেষজ্ঞ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষণ মিশন (১৯৫২-৫৩) শেষ করার পর
কিছু সুপারিশ করেছিলেন যেখানে জ্ঞান চর্চার আলাদা বিষয় হিসেবে ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান বিভাগ চালু করার কথা বলা হয়। ১৯৫৬ সালে
সমাজবিজ্ঞানকে একটি ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে গণ্য করে পাকিস্তান সরকার
Central Suparior Service (CSS)
সিলেবাস অন্তর্ভুক্ত করে। এটা এমন একটি ঘটনা যা বাংলাদেশের সমাজবিজ্ঞান
শিক্ষার জন্য ঐতিহাসিক ও উল্লেখযোগ্য। মূলতঃ সমাজবিজ্ঞানের ডিগ্রীর পর
চাকুরীর নিশ্চয়তা সহ বিভিন্ন বিষয়ের সুযোগ সৃষ্টির ফলে ১৯৫৭ সালে
UNESCO
সহযোগিতায় প্রথম স্বতন্ত্র বিষয় হিসেবে বাংলাদেশ সমাজবিজ্ঞান বিভাগ একটি
স্বাধীন স্বাতন্ত্র শিক্ষাগত বিষয় হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে প্রাথমিক পর্যায়ে ৫ জন শিক্ষক
যোগদান করেন। (১)
A K
Nazmul Karim (২)
Pierre Bessaignet (নৃবিজ্ঞানী)
(৩)
M Obaidullah (পরিসংখ্যানবিদ)
(৪)
H.Zaidi (মনোবিজ্ঞানী)
(৫)
John.E.Wean (নৃবিজ্ঞানী)।
পরবর্তীতে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে কয়েকজন বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী যোগদান করায়
বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক শিক্ষা কার্যক্রমে এর অবস্থান সুদৃঢ় হয়। প্রথম
দিকে সমাজবিজ্ঞান বিভাগ সম্পূর্ণভাবে আন্তর্জাতিক মানের ছিল এবং সেভাবেই
বিকাশ লাভ করেছিল। পরবর্তীতে ১৯৬৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও ১৯৭০
সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বতন্ত্র বিষয় হিসেবে সমাজবিজ্ঞান বিভাগ
চালু করা হয়। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর দেশে সামাজিক ক্ষেত্রে চরম
অস্থিতিশীল পরিবেশ ও নৈরাজ্যমূলক অবস্থার মোকাবেলার জন্য সমাজবিজ্ঞানীদের
প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল এর ফলশ্রুতিতে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের গুরুত্ব বহুগুণে
বৃদ্ধি পায়।
বর্তমানে বাংলাদেশে ৪টি সাধারণ এবং দুটি প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে
সমাজবিজ্ঞান বিষয়ের শিক্ষণ ও প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এছাড়াও সমাজবিজ্ঞানকে
একটি বিষয় হিসেবে অনেক বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কারিকুলামে
অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে।
সময়ের পরিবর্তনের সাথে,
বিভাগীয় কারিকুলাম পুনঃর্বিন্যাস করা হচ্ছে যাতে করে জ্ঞানচর্চার বিষয়
হিসেবে সমাজবিজ্ঞানের সাম্প্রতিক উন্নয়ন অর্জন সমূহ সম্পর্কে এ অঞ্চলের
শিক্ষার্থীদের যথাযথ পাঠদান করা সম্ভব। উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়
সমুহের পাঠ্যক্রমের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বিভাগে ৩ বছরের পরিবর্তে
সমাজবিজ্ঞানে অনার্স পর্যায়ে ৪ বছর মেয়াদী সমন্বিত কোর্স পদ্ধতি চালু করা
হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের মধ্যে সমাজবিজ্ঞান
বিভাগ সবচাইতে বড় বিভাগ।
একাডেমি কার্যক্রমের পাশাপাশি সহশিক্ষা কার্যক্রমেও সমাজবিজ্ঞান বিভাগে
বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনে উজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। প্রতি বছর
‘নাজমুল
করীম স্মারক বক্তৃতামালা’
দেশ বিদেশের প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী ও বুদ্ধিজীবিরা সমসাময়িক গুরুত্বপূর্ণ
বিষয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন ও আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছেন। ইতোমধ্যে অতিথি
বক্তাদের পঠিত প্রবন্ধাবলীর একটি সংকলন প্রকাশ করা হয়েছে। এ ছাড়াও
বিভাগের অন্তর্ভুক্ত
Nazmul Karim Study Center
বিভিন্ন গবেষণা কর্ম গ্রহণ ও সম্পাদনের কাজ হাতে নিয়েছে। এর ভিতর
উল্লেখযোগ্য সেন্টার কর্তৃক
Journal of Sociology
নামক গবেষণা পত্রিকার প্রকাশন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল এবং
ক্রীড়া ক্ষেত্রেও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ উত্তরোত্তর সাফল্যের স্বাক্ষর রাখছে।
বাংলাদেশের সংস্কৃতি অঙ্গনে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অবদান ও পরিচিতি
সর্বজনবিদিত। কেবল তাই নয়,
দেশ পরিচালনা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রেও এই বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীদের
দীপ্ত পদচারণা আমাদের গর্বিত করে। |